মনুষ্যত্ব
এক
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার আত্রাই নদীর তীরে বেড়ে উঠে আফজাল হোসেন । বাবা কৃষক, মা ও ছোট দুই বোনসহ পাঁচ জনের সংসার । আফজাল তিন ভাই বোনের মধ্যে বড় সন্তান । অনেক টানাটানির সংসারেও আফজাল জিপিএ ৫ গ্রেড নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে আফজাল । তার ইচ্ছে ছিল বড় ডাক্তার হবে । বীরগঞ্জে সরকারি কোন মেডিক্যাল কলেজ নেই । শুনেছে ঢাকায় অনেক সরকারি মেডিক্যাল কলেজ আছে । সেখানে অল্প খরচে সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে ডাক্তারি পড়া যায় । আর সে কারণেই তার মাকে দেওয়া শেষ সম্বল আফজালের দাদীর এক জোড়া হাতের বালা, একটা নাকের নথ আর কিছু জমানো টাকা নিয়ে পাড়ি জমায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ।
ঢাকায় আফজালের পরিচিত বলতে শুধু মায়ের দুঃসম্পর্কের এক ভাই ছিল বক্কর আলী । বক্কর আলী ঢাকার মিরপুরে এক রূমের একটা বাসায় ব্যাচেলর থাকতো । একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে স্টোর সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করেন । আফজাল তার ওখানেই উঠলো ।
দেখতে দেখতে দু'মাস কেটে গেল । সরকারি এক মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিল । পরীক্ষাও বেশ ভালোই হলো । কিন্তু ভাইবাতে যাওয়ার পর আফজালকে বলা হলো, "শোনো আফজাল! তোমার মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক দুটোর রেজাল্টই ভালো । আর তুমি এডমিশন টেস্টেও ৯৫% মার্ক পেয়েছো । সব মিলিয়ে তুমি মেডিক্যালে পড়ার যোগ্য । কিন্তু এবার অনেক কেন্ডিডেট । আর আমাদের কলেজের কিছু উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ডোনেশন প্রয়োজন । তো ভর্তির জন্য কলেজ ফান্ডে ৩ লক্ষ টাকা ডোনেশন দিতে হবে । নয়তো আমরা ভর্তি করাতে পারবো না ।"
আফজালের স্বপ্ন যেন তখনি ভেঙে যায় । আফজাল বাসায় চলে আসে । গত সপ্তাহে বক্কর মামার সাথে যেয়ে মায়ের দেয়া বালা জোড়া আর নাকের নথ বিক্রি করে ২৬ হাজার ২৫০ টাকা পেয়েছিল । আর নগদ মিলিয়ে আফজালের হাতে আছে মোট ৩০ হাজার ৭৫০ টাকা । আফজালের চোখ থেকে টপটপ চোখের জল ঝরে পড়ছে । কচুর পাতায় যেমনি বৃষ্টির পানি জমে তেমনি হাতের টাকা গুলোয় জমা হচ্ছে চোখের পানি । আফজাল যেন সেই পানিতেই তলিয়ে যাচ্ছে । চারিদিকে অথৈ পানি । শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ক্রমশ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে । আর আফজাল পানির স্রোতে ভাসে যাচ্ছে । দুচোখ ঝাপসা লাগছে । চোখের পাতা গুলো আটকে যাচ্ছে । আফজাল দুদিন না খেয়ে ছিল । স্বপ্ন ভাঙার কষ্টে মুখে কিছু তুলতে পারেনি । দুদিন-দুরাত্রি আফজাল এক ফোঁটা ঘুমোতে পারেনি । সারা দিন-রাত আফজাল শুধু কেঁদেছে ।
আফজাল আর ভর্তি হতে পারেনি মেডিক্যাল কলেজে । ওদিকে বাড়ি থেকে বক্কর মামার কাছে ফোন আসে । আফজালের বাবার শরীর খারাপ । আবার হালের গরুটাও নাকি মরে গেছে । আফজাল তার ভর্তির টাকা থেকে হাজার বিশেক টাকা পাঠিয়ে দেয় গ্রামে একটা গরু ও বাবার ঔষধ কিনতে । আর বলে সরকারি কলেজ তো, তাই ভর্তিতে টাকা কম লাগছে । সেদিনও আফজাল খুব কেঁদেছিল ।
আরও তিন মাস কেটে গেল । আফজাল আর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারেনি । একটি সরকারি কলেজে ডিগ্রিতে ভর্তি হতে হয় । দুঃসম্পর্কের মামার ঘাড়ে বসেই বা কদিন খাওয়া যায় । মামার পরিচিতির সুবাদে অন্য একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে সেলস রিপ্রেজিন্টিভের একটি চাকরিও পেয়ে যায় আফজাল । বেতন কম হলেও শৃন্য মরূভৃমিতে এক মশক জলই বা কম কিসের ।
চাকরির বয়েস ছয় মাস পার হলো । বেশ চলছিল আফজালের । ততোদিনে শহরের অনেক কিছুই আয়ত্ত করে নিয়েছে । অনেকের সাথেই পরিচিতি বেড়েছে । দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে পরিচিতি আর অভিজ্ঞতাই বেড়েছে । বাড়েনি কেবল অর্থের মানদণ্ড । ভালো কোন চাকরিও জুটছে না । ওদিকে বোন দুটাও এবার মাধ্যমিকে পা দিয়েছে, সাথে খরচও বেড়েছে । আফজাল থাকা-খাওয়ার টাকা আর অল্প কিছু রেখে বাকিটা বাড়িতেই পাঠিয়ে দিত । বেশ কয়েকবার আফজাল তার ঊর্ধ্বতন স্যারকে বেতন কিছুটা বাড়াতে অনুরোধ করেছিল । কিন্তু বাড়ে নি । আফজালের সাথে পরিচয় হয় অন্য একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এক এসআর (সেলস রিপ্রেজেন্টিভ) কোরবান এর সাথে । এসআর পরিচয় দিলেও কোরবান ছিল আসলে দালাল প্রকৃতির । কোরবানের বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির উপরের লেবেলের অফিসারদের সাথে পরিচিত ছিল । কেউ স্টোর কিপার, কেউ এডমিনেষ্ট্রশন, কেউ এইচ আর ডিপার্টমেন্ট, এমনকি বিভিন্ন কোম্পানির এমডি ও জিএম এর সাথেও তার পরিচয় ছিল । আর তাদের মাধ্যমে কোরবান ঐ সকল কোম্পানির ডেট এক্সপায়ারড মানে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ঔষধ গুলো খুব সামান্য নাম মাত্র দামে কিনে নিত । তারপর মিডফোর্ডে তার এক ফুফাতো ভাইয়ের মাধ্যমে সেই ঔষধের প্যাকেট তৈরী করতো নতুন ডেট দিয়ে । আর সোবহান নামে একজন ছিল । যে কিনা ট্যাবলেটের গায়ের ডেট সমান করে মুছে দিয়ে তার উপর নতুন ডেট এর খোদাই বসিয়ে দিত । আর তারপর কোরবান সেগুলো বিভিন্ন ফার্মেসিতে নিজে এবং অন্য কারো মাধ্যমে নিজের পরিচয় গোপন করে এসআর পরিচয়ে স্বল্প দামে সেগুলো বিক্রি করতো । আর দোকানদাররাও স্বল্প দামে পেয়ে আর বেশি লাভের আশায় এ ধরনের দালাল বা বিক্রেতার জন্য ক্ষুদার্ত কুকুরের মতো হা করে বসে থাকতো । এক রকম সখ্যতা গড়ে কোরবান আফজালের সাথে । তারপর একদিন আফজালকে কোরবান বলে,
- দেখেন কোরবান ভাই । এইখানে আপনে যতোই কষ্ট করেন না কেন কোম্পানি আপনের বেতন বাড়াইবো না । আপনে যতোই নিজের মনে কইরা সৎ হইয়া কাম করেন না কেন, মাস শেষে দেখবেন বড় টারগেট ধরাইয়া দিছে । আর হেইডা ফিলাপ না হইলে আর বেতনও বাড়বো না ।
- কি কন কোরবান ভাই ?
- হ ভাই । আমি এই কোম্পানিতে ছয় বছর হইলো চাকরি করি । আমার বেতন বাড়ছে দুই বছর পর ।
- তাইলে এহন কি করমু ?
- শোনেন আফজাল ভাই । শুধু এই চাকরি করলে হইবো না । আপনি আমার মতো সাথে অন্য কোম্পানির মালও বেঁচেন । সাপ্লাই আমি দিমু । আপনি শুধু দোকানে দিয়া আসবেন ।
তারপর বিস্তারিত সব শুনে আফজাল রাজি হয় না । তার দ্বারা এই লোক ঠকানো সম্ভব হবে না । যে কিনা ডাক্তার হতে চেয়েছিল মানুষের সেবা করার জন্য আজ সে মানুষকে ঠকিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে ? না করে দেয় আফজাল কোরবানকে । কিন্তু কোরবান প্রতিদিনই আফজালকে নানা ধরনের অভাব অনটনের কথা বলে ও বিভিন্ন লাভের লোভ দেখিয়ে প্ররোচিত করতে থাকে । রীতিমতো যাকে বলে ব্রেইন ওয়াশ এবং একটা পর্যায়ে আফজাল কোরবানের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে । আর সাথে সাথে আফজাল মিরপুর, ফার্মগেট, শ্যামলী, আদাবর, দারুস সালাম, টেকনিক্যাল, আনসার ক্যাম্প সহ বিভিন্ন স্থানের ফার্মেসিতে সেই মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ সাপ্লাই দেয় । আফজালের রক্তের সরলতা যেন লালসার চৌকসতায় রূপ নিয়েছে । যখনই পকেটে অতিরিক্ত টাকা ঢুকছে তখন থেকেই যেন হিতাহিতবোধশূন্য হয়ে যাচ্ছে সে । তার চিন্তা চেতনা থেকে এটাও মুছে গেল যে, কোরবানের এ মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ পৌঁছে যেতে পারে তার অসুস্থ বাবার মুখে । অর্থের লোভ-লালসায় মনুষ্যত্ব যেন মাটি চাঁপা পড়ে যায় ।
দুই
জামিল চৌদুরী, অধ্যাপক, সমাজ কল্যাণ বিভাগ, সরকারি বাঙলা কলেজ । একজন ভালো মানুষের সকল গুণই তার মধ্যে ছিল । যেমনি ন্যায় পরায়ণ , তেমনি পরোপকারীও ছিলেন । তার সমস্ত ছাত্ররাই তাকে খুব সম্মান করতো আর ভালোও বাসতো । দুই পুত্র সন্তানের জনক জামিল চৌদুরী তার সহধর্মিণীর সাথে দুজনে মিলেই থাকে দারূস সালাম রোডের ছোট্ট একটা বাড়িতে । গত ২৩ বছর ধরে তিনি সরকারি বাঙলা কলেজে অধ্যাপনা করে আসছেন । স্ত্রী ডিগ্রী পাশ হলেও বিয়ের পর থেকেই গৃহিণী । বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফাইন্যান্সে মাস্টার্স পাশ করে একটি এনজিও এর হেড অব ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে জব করে আলাদা থাকে । চাকুরির বয়স ৪ বছর হলেও চাকুরি পাওয়ার ৬ মাসের মাথায়ই বিয়ে করে ফেলে । আর তার পরই আলাদা হয়ে যায় সে । আর ছোট ছেলে বড় ভাই চলে যাওয়ার বছর খানেক পরেই বাবার কিছু জমানো আর ব্যাংকের টাকা চুরি করে বাসা থেকে পালিয়ে যেয়ে ছোট্ট একটি আইটি কোম্পানি দেয় । আর গত তিন বছরে সেটা ফুলে ফেঁপে বিশাল হয়েছে । এখন তার কোম্পানিতে ২২ জন এম্প্লয়ি চাকরি করে । প্রতি মাসেই সে দু একবার বিদেশ ভ্রমণ করে । এইতো সামনের মাসে বিয়ে করছে । মেয়ে কোন এক গার্মেন্টস মালিকের মেয়ে । কিন্তু ছোট ছেলেও একই । বাবা-মার খোঁজ সেও নেয় না ।
জামিল সাহেব একজন সৎ ও আদর্শবান মানুষ ছিলেন । আর তার সন্তানদেরও তার মতো তৈরি করতে চেয়েছিলেন । শিক্ষা-দিক্ষা সমস্ত কিছু দিয়ে চেয়েছিলেন মানুষের মতো মানুষ বানাতে । কিন্তু জামিল সাহেবের আজ একটাই আক্ষেপ, তিনি তার সন্তানদের শিক্ষিত করতে পেরেছেন । কিন্তু মানুষ করতে পারেননি । তারা অর্থের দামে বিক্রি করে দিয়েছে শিক্ষা আর মনুষ্যত্ব । সে যাই হোক, যেহেতু একতালা একটি নিজের বাড়ি ছিল । সে কারণে কলেজ থেকে যে বেতন পেত তা দিয়ে খেয়ে পড়ে তাদের দুজনের সংসার কোন রকমের চলেই যাচ্ছিল । বার্ধক্যের দূর্বলতার সুযোগটা সন্তানদের মতো নানা রকম অসুখ-বিসুখও নিয়ে থাকে । আর সে সুযোগটা দ্বিতীয় পুত্র চলে যাবার পর থেকেই বেশি নিয়েছিল ।
সেবারই প্রথম স্টোক করে জামিল সাহেব । এছাড়া হার্টের আরও নানা সমস্যা তো ছিলোই । আর তাই নিয়মিত ঔষধ খেতে হতো । প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার একসাথে সাত দিনের ঔষধ কিনত । কারণ, ঔষধ পরিবর্তন না হলেও সঃসারের টুকিটাকি খরচ মেটানোর জন্য একসাথে কিনতে পারতো না । শুক্রবার জামিল সাহেব ও তার সহধর্মিণী দুজনেরই তাদের সন্তানদের কথা মনে পড়ছিল । সন্তানরা যদিও তার খোঁজ খবর নিত না । তবুও জামিল সাহেব মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে কথা বলতেন । কখনো সন্তানরা দু'চার মিনিট কথা বলতো । কখনো বা ব্যস্ততা দেখিয়ে সে সময়টুকুও দিত না । বাবা-মা আর সন্তানের সম্পর্কটা ঠিক ঐ পাহাড় আর ঝর্নার মতো । সারাটা জীবন বুক পেতে আগলে রাখে । আর যখন সন্তান দূরে চলে যায়, ঝর্ণা যেমন পাহাড়ের বুক বেয়ে হারিয়ে যায় দূরে । আর পাহাড়ের বুকে রেখে যায় স্থায়ী একটা দাগ । তেমনি সন্তান যতোই দূরে যাক, সন্তানের জন্য বাবা-মার মনেও ভালোবাসার এক দাগ থেকে যায় । যা চিরজীবনই অমুছনীয় । তো তাদের কথা ভাবতে ভাবতেই শুক্রবার যখন ফোন দিয়ে কথা বলতে পারেনি । তাল পরপরই জামিল সাহেবের বুকে খুুুব ব্যাথ্যা হয় । শুক্র-শনি দুটো দিনই রাতে ঘুমোতে পারেনি জামিল সাহেবের সহধর্মিণী । আর অন্য কেউ ছিলও না তাদের দেখভাল করার মতো । তার সন্তানগণ, যারা ছিল তার সারা জীবনের ধন-সম্পদ । সেও যেন হারিয়ে আজ নিঃস্ব তারা । রবিবার রাতেই হঠাৎ বুকের ব্যাথ্যা বেড়ে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে স্টোক করে মারা যায় জামিল সাহেব । একজন ভালো মানুষ হারিয়ে গেল দুনিয়া থেকে । ইচ্ছা ছিল এক নজর দেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার । তা আর হলো না । অনেক কষ্ট বুকে নিয়ে দুনিয়ায় তার সহধর্মিণীকে একা ফেলে চলে যেতে হলো তাকে ।
পিতার শেষ মুখটিও দেখতে আসেনি সন্তানেরা । বড় সন্তান কক্সবাজারে গিয়েছিল তার বাচ্চার স্কুলের ভেকশনে । আর ছোটটি ব্যবসায়ের কাজে থাইল্যান্ড ছিল । বাবার মৃত্যুও তাদের মনুষ্যত্বতো জাগাতে পারেইনি । বরং তারা হয়ে উঠলো আরও অমানুষ । এক সপ্তাহ পর তারা বাড়িতে আসে । এসে দেখে মা অসুস্থ বিছানায় পড়ে গেছে । পাশের বাসা থেকে মানবতার খাতিরে কয়েকদিন ধরে দু'বেলা খাবার দিয়ে যাচ্ছে । সন্তানগণ তা দেখে অনেক চিন্তায় পড়ে গেল । তখন তার দু সন্তানের মাঝে কথোপকথন :
বড় ছেলে : এখানে মা এই অবস্থায় একা কী করে থাকবে ? তার উপর আবার অসুস্থ ।
ছোট ছেলে : হ্যাঁ ঠিকই তো বলেছো । উনাকে দেখাশোনা কে করবে ?
বড় ছেলে : বড়ই চিন্তার বিষয় । আমার বাসাতো খুবই ছোট । তার উপর রুম মাত্র তিনটে । একটায় তো আমরা থাকি । অন্যটায় তোর ভাতিজা থাকে । আরেকটা আছে সেটাতে তোর ভাবির ছোট ভাই এসে মাঝে সাঝে থাকে । মাকে বরং তুই সাথে নিয়ে যা ।
ছোট ছেলে : কি বলো ! দু সপ্তাহ পর আমার বিয়ে । আর আমার বৌ এসব পছন্দ করে না । ও বাড়িতে বাইরের কাউকে অ্যালাওই করবে না বলে দিছে । আমার নতুন বিয়ে । আমি কোন ঝামেলা চাই না ।
বড় ছেলে : তাহলে এখন কী করবো ?
ছোট ছেলে : আমি কিছু জানি না । তোমার যা খুশি করো ।
বড় ছেলে : তাহলে চলো কোন এক ওল্ডেজ হোমে রেখে আসি ।
অবশেষে সকল ঝামেলার অবসান ঘটলো । দুইভাই মিলে মাকে এক ওল্ডেজ হোমে রেখে আসলো । তারপর তার বাবার যে ছোট্ট বাড়িটা ছিল তা বিক্রি করে তার অর্থ দুভাই ভাগ করে নিল । মনুষ্যত্ব আর মানবতা বিক্রি হয়ে গেলে ওল্ডেজ হোমে, সেটাও আবার বিনা মূল্যে ।
তিন
মোহাম্মদপুর হাউজিং এলাকায় থাকে রিংকু । হয়তো ভাবছেন রিংকু ছেলে ? না, রিংকু ছেলেও নয় বা মেয়েও নয় । হ্যাঁ, রিংকু উভয় লিঙ্গ । আমরা যাকে বলি হিজড়া । ও হাউজিং এলাকার নিমতলী বস্তিতে তার মতোই আরোও চারজন সঙ্গীসহ একসাথে থাকে । সমাজের উঁচু শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষগুলো এদেরকে এতোটাই নিচু করে রেখেছে যে, কুকুরের অবস্থানও এদের তুলনায় সম্মানজনক ।
রিংকু আর ওর সহকর্মীরা প্রায় বছরখানেক হলো এ মহল্লায় থাকে । ওরা যখন এখানে আসে তখন অনেক বড় বড় অফিস-আদালতে গিয়েছে যে কোন একটা চাকরির জন্য । কিন্তু কেউ তাদের কোন চাকরি দেয় নি । ঘাঁড় ধাক্কা দিয়ে আর অপমান করে সবাই বের করে দেয় । তারপরও হাল ছাড়েনি । মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়েছে যেকোন একটা কাজের জন্য । তারা কষ্ট করে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে চায় । মানুষের গলগ্রহ বা ভিক্ষাবৃত্তি তারাও করতে চায় না । কিন্তু এ শিক্ষিত সমাজ যারা কিনা ইংরেজীতে গলা উঁচু করে লাগামহীন কথাই বলে গেছে । মানবতার জন্য কখনো কোনো কাজে হাত পর্যন্ত লাগায়নি । তারা কোন চাকরি বা কাজ দিয়ে সুন্দর জীবন-যাপনে বা বাঁচার জন্য সাহায্য করেনি । বরং প্রতিবার তাদের ঠেলে দিছে লাঞ্ছনা আর অন্ধকারে । আর পরিশেষে বেছে নিতে বাধ্য হয় সেই সকল কাজ যা আমরা হরহামেশাই দেখে থাকি । তার জন্য প্রকৃতপক্ষে কারা দায়ী ? ওরা নাকি আমরা ? আমরাতো কখনোই নয় । কারণ আমরা যে পরিপূর্ণ মানুষ । আমরা শিক্ষিত সমাজ । মনুষ্যত্ব না থাকলেও আমরাই সমাজের অংশীদার ।
এইতো গত সপ্তাহে রিংকুর দুই সহকর্মী মোহাম্মদপুর টাউনহল মার্কেটে যায় টাকা উঠাতে । সব দোকান থেকেই দেয় । কিন্তু চাঁন মিয়া দেয় না । তার এ দোকানে তিনটা দোকান । দুটো ভাড়া দেয়া আরেকটা নিজে চালায় । এছাড়াও মোহাম্মদপুরের কাশর এলাকায় তার নিজের পৈতৃক বাড়ি আছে । তো যখন উনার দোকানে যেয়ে রিংকুর সহকর্মী দুজন টাকা চায় চাঁন মিয়া তখন অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে । তখন তারা কিছুটা রেগে চিৎকার করে কথা বলায় চাঁন মিয়া দোকান থেকে একটা গজারী কাঠ বের করে এমন ভাবে ওদের পেটায় যে একজনের বা হাতের একটা আঙুল ভেঙ্গে যায় । কিন্তু এ বিচার কে করবে । সমাজে রিংকুরা যে বড্ড অসহায় ।
আরেকদিন মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের এক বাড়িতে এক মহিলার বাচ্চা হয়েছে । তো আমরা তো এমনিতে কাউকে কিছু দিতে চাই না । কিন্তু কোন খুশির খবর থাকলে বা আনন্দের কিছু ঘটলে আমরা তখন কিছুটা হলেও উদারতা দেখাই বা খুশি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেই । রিংকুও ভাবলো, ওদের বাবু হবে । দোয়া করে দিয়ে আসবে সবাই । আর কিছু সাহায্য চাইবে । খুশি হয়ে যদি কিছু দেয় সেই আশায় মহিলার বাসায় যায় । কিন্তু রিংকুরা যখন সে বাসায় যেয়ে সাহায্য চায় সে পরিবার তখন টাকা দেবার কথা বলে, দাঁড় করিয়ে রেখে থানায় ফোন দিয়ে ওদের মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ধরিয়ে দেয় । চার দিন ওরা থানায় আটকে থাকার পর ছাড়া পায় ।
কদিন আগে যখন মোহাম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পে আগুন লেগে যায় । তখন কাউকে পাওয়া যায় নি । উদ্ধার কর্মীরাও সময়মতো আসেনি । কিন্তু এই রিংকুরাই আগুন লাগা, পুড়ে যাওয়া ঘর থেকে তিনটা শিশুকে উদ্ধার করেছে । নিজেরা ভ্যান চালিয়ে এক বৃদ্ধাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেছে বিনা স্বার্থে । আবার এলাকার সেই হাজী ফালু মিয়া, যে কিনা ওদেরকে এলাকা থেকেই বের করে দিতে চেয়েছিল । কী তাদের অপরাধ ? হ্যাঁ, ওরা হিজড়া তাই । ওদের জন্য নাকি এলাকার শিশু-কিশোররা খারাপ হয়ে যাচ্ছে । সেই হাজী ফালু মিয়ার নাতি যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোন এক শিক্ষিত মানুষের প্রাইভেট কারের নিচে পড়ে অ্যাকসিডেন্ট করে । তখন সেই শিক্ষিত মানুষটি পালিয়ে গেলেও পালাতে পারেনি রিংকু । ওর বিবেক ওকে থামিয়ে দিয়েছে । সেই রিংকুই হাজী ফালুর নাতীকে নিজে হাসপাতালে নিয়ে যায় । রক্তের যখন প্রয়োজন হয় তখন নিজের রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় রক্ত দিতেও দ্বিধা করেনি । বাঁচিয়ে দিয়েছে তার নাতীকে । তবুও ওরা মানুষ না, ওরা হিজড়া ।
মানুষ তো আমরা, যারা শিক্ষার নামে চোখে দেখেও না দেখার ভান করার প্রলেপ মেখে বসে আছি । মানুষ তো আমরা, যারা অর্থের লালসায় বিকিয়ে দিতে পেরেছি বিবেক । মানুষ তো আমরা, যারা অসহায়ের কান্না ধৈর্য্য ধরে শুনতে পারি । মানুষ তো আমরা, যারা অমানুষ হওয়া স্বত্বেও মানুষের মুখোশ পড়ে থাকতে পারি ।
"শিক্ষা একজনকে শিক্ষিত করে তুলতে পারে । কিন্তু মানুষ করতে পারে না ।"
(সমস্ত গল্প, ঘটনা, চরিত্র, স্থান ও প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ কাল্পনিক । বাস্তব জীবনের সাথে কোন মিল নেই । তারপরও আংশিক বা সম্পূর্ণ ঘটনা বা চরিত্র যদি কোন ব্যক্তি বা ঘটনার সাথে মিলে যায় তার জন্য লেখক দায়ী নয় ।)
30 May 2020 at 05:00PM
-- নোট :--
এই লেখার সমস্ত স্বত্বাধিকার © "রহিম বাদশা" এর সংরক্ষিত। এই লেখার কোন অংশই লেখকের অনুমতি ব্যতীত ফটোকপি, রেকর্ডিং, বা অন্যান্য বৈদ্যুতিক বা যান্ত্রিক পদ্ধতি সহ, কোনও আকারে বা কোনও উপায়ে পুনরুতপাদন, বিতরণ বা প্রেরণ করা যাবে না । তবে শেয়ার এবং লেখকের ক্রেডিট দেয়ার শর্তে অনুমতি দেয়া হলো।
অনুমতি অনুরোধের জন্য, লেখকের কাছে চিঠি লিখুন, নীচের ঠিকানায় -
No comments